"দাদা ঝালমুড়ি দেব
নাকি ?" - পার্কে প্রবেশ পথে নিত্য বসে থাকা ঝালমুড়িওয়ালা
জিগেশ করলো. "না রে এখন না , জানিস তো সব,
শুধোচ্ছিস কেন তবে ?
" - হালকা হেসে উত্তর দিলাম. বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে পনের মিনিট মতো লাগে এই
পার্ক টিতে আসতে. শান্তিতে মনোরম পরিবেশে বসে কিছু সাহিত্য রচনার তাগিদে এখানে আসা
টা আমার বেশ পুরানো অভ্যাস . আর কয়েক বছর আগে সংযোজিত হয়েছে আরো একটি উদ্দেশ্য ;
ওর কাজ থেকে ফেরার
অপেক্ষা করা, তৎপর একত্রে
বাসার দিকে পায়ে হেঁটে রওনা হওয়া, অভ্যাসগত ভাবে
ওর কেনা ঝালমুড়ি খেতে খেতে . তার নাম সুলেখা - কিছুটা ছেলেমানুষ , খানিকটা যত্নশীল এবং পুরোপুরি স্বনির্ভর এক
নারী , আমার প্রেম ; তবে সেটি ওকে জানানো হয়নি কখনো, তা সে সঠিক সময়ের অপেক্ষাতেই হোক বা ওকে
হারানোর ভয়ে ; যদি ও বন্ধু থেকে বেশি
এগোতেই না চায় এই সম্পর্ক টিকে . "প্রদীপ তোর আবোল তাবোল লেখাগুলো হলো ?"
- পিছন থেকে সুলেখার ইষৎ
উচ্চ কণ্ঠস্বরে কথাটি কানে এলো. লিখতে লিখতে খেয়ালই করিনি যে , ওর ফেরার সময় হয়েছে . "এ তো সবে শুরু ,
সারা জীবন লিখে যাওয়ার
ইচ্ছা আছে" - ঘাড় টি কিছুটা ঘুরিয়ে আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে
উচ্চস্বরেই ওকে জবাব দিলাম. তৎপর খাতা আর কলম টি আমার ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়ে ওর সাথে
হাঁটা শুরু করলাম . "গতকাল মা
গেছিলো তোর কাছে ? তা কি কথা হলো ?"
-মুড়ির ঠোঙা টা এক হাতে
আমার দিকে বাড়িয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু মুড়ি খেতে খেতে প্রশ্নটি করলো.
"হ্যাঁ, মানে... তেমন
কিছু নয় " - আমি একটু আমতা আমতা করতে করতে উত্তর দিলাম . গতকাল রাতে সুলেখার মা আমার সাথে দেখা করতে
এসেছিলেন, মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে . সুলেখার পরিবারের ইচ্ছা, আমি সুলেখা কে বিয়ে করি এবং এই প্রস্তাবটি আমিই তাকে জানাই .কারণ তাঁদের কথায়
সুলেখা বিয়ে করবে না বলে মনস্থির করেছে প্রায় আট বছর আগে. একুশ বছর বয়স তখন
সুলেখার, কলেজ পাশ করতেই ও আমায় জানায় যে , ও ওর কয়েক মাস dating করা ছেলেটিকে বিয়ে করে নেবে এবার . ছেলেটি ওর
মন মতো , smart , handsome , বেশ ভালো একটি কোম্পানিতে চাকরি করে. কিন্তু
শেষমেস সুলেখার বাড়ির লোকের হস্তক্ষেপে তা আর হয়নি . তাদের মনে হয়েছিল নিম্ন
মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হয়ে সে যে এক high
lifestyle এর দিকে আকর্ষিত
হয়েছে , তা ওর নেহাতই ছেলেমানুষি . তখনি ও সিদ্ধান্ত
নিয়েছিল , পরিবারের কারুর কথায় কাউকে ও বিয়ে করবে না কোন
দিন আর সেই জেদ এখনো বজায় রেখেছে ও .
সুলেখা কে এখনো আমার মনের কথাটি না জানাতে পাড়ার কারণ এটিও যে , আমার মতো সাধারণ
ছেলে , যার শিক্ষকতা আর সাহিত্য রচনা করে সংসার চলে, তাকে কি ও জীবনসাথী রূপে স্বীকার করবে আদৌ .
নৈশভোজে বসে আজ খাবারের প্রতি একটুও মনোযোগ নেই
আমার . বারবার সুলেখার মুখটা মনে পড়ছে . ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসার সময় ওর চোখে মুখে অভিমানের ছায়া ধরা পড়েছিল , কিন্তু কেন ? কিসের অভিমান ? . আর তার উপর সুলেখার মায়ের কথা গুলিও মাথায় ঘুরপাক করছে . তাহলে কি এবার আমার
জানানো উচিত সুলেখাকে , আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে ওর জন্য রাখা স্থান
টির সম্বন্ধে . সব ঘেঁটে ঘ হয়ে রয়েছে . খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে বেডরুমে আসতেই
মোবাইল ফোন টা বেজে উঠলো , সুলেখা call করেছে . এই ringtone টি ওর number এই set করা . call টা receive করে বললাম - "এখন ফোন করলি হঠাৎ ?" . উত্তর টা না দিয়েই ও স্থির কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন
করলো - " খাওয়া হয়েছে তোর ?"
. " হ্যাঁ, এই হলো" - আমি বললাম. তারপর ও অনেক কথা বলা শুরু করলো , কিন্তু তাতে মনসংযোগ করতে ব্যর্থ হচ্ছি আমি . আমার ভিতর তোলপাড় করছে দুটি
আওয়াজ , দুই আমি . এক আমি বলছে , " বলে দে তোর মনের কথা , কিসের অপেক্ষা করছিস ? সঠিক সময়ের প্রত্যাশায় সময় কে হাতছাড়া করছিস . চাস না এই মেয়েটিকে তোর
জীবনসাথী রূপে ? চাস না ওকে সুখী করতে , যতনে রাখতে ? বলে দে তবে. " . আর অন্য আমি সতর্ক করে
বলছে , "দেখিস , অতি লোভে যা আছে
তাও হারাস না যেন" . "hello
, কিরে শুনছিস আমার কথা ?" - কিঞ্চিৎ উচ্চস্বরে এবং বিরক্ত সহকারে সুলেখার
করা প্রশ্নটিতে আমি ওর কথায় মনসংযোগ করলাম. হালকা ঢোক গিলে বললাম - "হ্যাঁ
শুনছি তো , বল" . "কাল আমার কাজ থেকে ফিরতে একটু
দেরি হবে , অপেক্ষা করিস please ." - হালকা হাসির সাথে
ও বললো. "সে তো না বললেও করবো " - আমি বললাম . তারপর কিছুক্ষন দুজনেই
চুপ , একে অপরকে শুভরাত্রি জানিয়ে ফোন টা ছেড়ে দিলাম .
গতকাল রাত্রে ঘুম আসেনি ভালো .সারা রাত ভেবেছি
আমার কি করণীয় তা নিয়ে. আর শেষমেস সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ ওকে সবটা জানানোর , মুখে বলে নয়, কাগজে লিখে . সেই মত লেখাটা শেষ করে ওর জন্য
পার্কে অপেক্ষা করছি অনেকক্ষণ, মনের মধ্যে একরাশ ভয় , প্রত্যাশা এবং আশঙ্কা নিয়ে . সুলেখা কে আমার
দিকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি উঠে ওর দিকে অগ্রসর হলাম . সম্মুখীন হতেই দেখি ও আমার
দিকে একটু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে . "অস্থির লাগছে কেন তোকে ?" - হালকা ভুরু কুচঁকে সুলেখা জিগেশ করলো. আমি একটা
ভাঁজ করা কাগজ ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম - "এই কাগজের টুকরোটি হতে পারে আজ
আমার ভাগ্যের চাবিকাঠি " . ও ওর সন্দেহে ভরা চোখ দুটি আমার চোখে রেখেই
ঝালমুড়ির ঠোঙা টা আমার হাতে ধরিয়ে কাগজ টি নিয়ে নিলো , আর নিঃশব্দে আমার লেখার উপর চোখ বোলাতে লাগলো . তাতে লিখেছি - "আমার
মুখের ভাষার থেকে আমার লেখনী
বেশী শক্তিশালী , আর তাতেই তোকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছি . জানিসই
তো , যদি আমায় কেউ মানাতে পারে , খুশি রাখতে পারে , সে হলো তুই . জানি আমি তোর স্বপ্নের রাজপুত্র
নই . কিন্তু, তোর সব স্বপ্ন
কে নিজের করে দেখতে পারি. তোর সব ভয় জয় করতে পারি . তাই একটা ছোট্ট অনুরোধ - please , আমার হবি ? " . লেখাটা পড়ে
সুলেখা একটি কথাও বলছে না , কিন্তু ওর চোখ দুটো বলছে . ওই দু চোখে আমি রাগ
দেখছি , যা আমার বেশ চেনা . এই রাগের বহির্প্রকাশ
তো ঘটে যখন, আমার জন্য ওকে
কোথাও বেশী অপেক্ষা করতে হয় . কিন্তু আমি যে হ্যাঁ কিংবা না এর মধ্যে কোনো একটি
জবাব খুঁজছি . হাজারটি প্রশ্ন মনে জাগছে আর ও চুপ করে রয়েছে , ওর ঠোঁট দুটি স্থির হয়ে রয়েছে . মনের মধ্যে চিৎকার করে বলছি - " কিছু তো
বল, চাইলে তিরস্কার কর কিন্তু এভাবে বাকরুদ্ধ হয়ে
থাকিস না" , কিন্তু মুখে একটি কথাও বলতে পারছি না. সুলেখা কিছু
না বলেই কাগজ টা ভাঁজ করে পার্কের
বাহির হওয়ার পথটি ধরে অগ্রসর হলো . তবে কি সব শেষ ? অতি লালসায় সত্যিই সব হারালাম ? দশ-বারো পা দূরে গিয়ে সুলেখা দাঁড়িয়ে পড়েছে হঠাৎ . আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না সে, কিছু ভাবছে বোধ হয় . কিছুক্ষণ এভাবেই উভয়ে দাঁড়িয়ে . তারপর ও ঘাড় ঘোরাতেই
গোধূলির আলোয় ওর মন্ত্রমুগ্ধ করা হাঁসি আমার চোখে পড়লো . আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে
জিগেস করলো - "আসছিস তো তুই ?
নাকি এতটা পথ আমাকে একাই
চলতে হবে ?" .
Comments
Post a Comment